দেনমোহর হিসেবে গাছের চারা নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেন সুকৃতি

নাজমুল হাসান, নাটোর: নগদ অর্থ বা গহনা নয়, দেনমোহর হিসেবে পরিবেশের উপকারি বন্ধু গাছের চারা নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন নাটোরের কনে সুকৃতি আদিত্য। এমন ব্যতিক্রমী দেনমোহরের কারণে আলোচিত হয়েছেন তিনি। সুকৃতি-নাবিন দম্পতি বিয়ের দিন গাছ লাগিয়ে বলেছেন, দেনমোহর নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে তা দূর করে ভালবাসাটাকে প্রাধান্য দিতেই গাছ নিয়ে তাদের এমন আয়োজন। ব্যতিক্রমি এই আয়োজনে চাঞ্চল্য তৈরী হয়েছে পুরো এলাকা জুড়ে। 
  
গেল শুক্রবার (২০ অক্টোবর) নাটোর সদর উপজেলার শহরতলী দিঘাপতিয়ায় ঐতিহাসিক উত্তরা গণভবনের পাশে গিয়ে দেখা গেল, একটি বিয়ে বাড়িতে আনন্দ, উচ্ছ্বাস, হৈ, হুল্লোড় চলছিল। এরই মাঝে কনে সুকৃতি আদিত্য ও বর নাবিন আদনান গাছের চারা রোপন করে তা পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। পূর্ব পরিচয় থাকলেও দুই পরিবারের সম্মতিতে ঘরোয়া পরিবেশেই বিয়ে সম্পন্ন হয় সুকৃতি-নাবিনের। আর বিয়ের অন্যতম আকর্ষন ছিল দেনমোহর হিসাবে পরিবেশবান্ধব গাছের চারা। দেনমোহর হিসাবে আপাতত বরের কাছ থেকে ৫টি ফলদ ও বনজ গাছের চারা গ্রহণ করেন কনে সুকৃতি। এমন ব্যতিক্রম বিয়েতে প্রশংসায় ভাসছেন সুকৃতি-নাবিন দম্পতি।.
 
কনে সুকৃতি ও তার বাবা মায়ের গাছ এবং পরিবেশের প্রতি রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকে তিনজনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সুকৃতি তার বিয়ের মোহরানা হিসেবে বেছে নেন গাছের চারা। পারিবারিকভাবে ধুমধাম করেই তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের আসরেই মোহরানা হিসেবে ৫টি ফলদ ও বনজ গাছের চারা হস্তান্তর করেন বরপক্ষ। টাকার অংকের হিসাবে না মিলিয়ে সুকৃতির এমন চিন্তা চেতনায় আনন্দিত সবাই। 

কনে সুকৃতি আদিত্য বলেন, বর্তমানে অনেক বিয়েতে দেনমোহর নিয়ে একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। আমার মনে হয় তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। কারণ, বিয়ে মানেই আর্থিক লেনদেনটা মুখ্য না। দু’টি মানুষের মনের মিল হওয়াটাই বড় ব্যাপার। সেখান থেকে মনে হলো যে যদি এমন কিছু করা যায়, যা আমাদের প্রকৃতিকেও সুস্থ রাখবে। সেই সাথে আমাদের সম্পর্কটাকেও সুস্থ রাখবে। তাই নতুন জীবন শুরু করার পূর্বে আমার মনে হয়েছে, গাছ একটা দারুণ উপকরণ হতে পারে, যেটার মাধ্যমে পরিবেশটাও সুস্থ থাকলো, আমরাও খুশি থাকলাম পরিবেশের সুস্থতা দেখে।
  
বর নাবিন আদনান জানান, দেনমোহরের বিষয়টা হচ্ছে মূলত নিরাপত্তা। আমার কাছে মনে হয় যে আমাদের নিরাপত্তার চাইতে পরিবেশের নিরাপত্তা বেশী জরুরী। এটা একটা প্রতীকী ব্যাপার। এর বাইরে বিশেষ কিছু নয়। প্রতীকী ব্যাপার হিসাবেই আমরা চর্চা করলাম যাতে আমরা পরিবেশ, প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থাকতে পারি। তাই আমি সুকৃতির ভিন্ন চিন্তাকে স্যালুট জানাই।

কনের বাবা এম. আসলাম লিটন জানান, তার মেয়ে সুকৃতি আদিত্য সিন্ধান্ত নিয়েছিল যে, বিয়েতে সে মোহরানা নেবে না। নিলেও সে একটা টোকেন নিতে চায়। অভিভাবক হিসাবে তারা সুকৃতির সেই সিন্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার মেয়ে মনে করে, বর্তমান সমাজে টাকার অংক বাড়িয়ে মোহরানা নেয়ার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সেই প্রতিযোগিতায় সুকৃতি থাকবে না। সমাজকে সে একটা বার্তা দিতে চায় যে, মোহরানাটা মূল নয়। মূল বিষয়টা হচ্ছে দু’টি মানুষের বন্ধন। দু’টি মানুষের হৃদয় মন এক হয় বিয়ের মধ্য দিয়ে। এই বন্ধনটাই আসল। কোন অর্থনৈতিক বিষয় বা সম্পদের জায়গায় গিয়ে চুক্তিবন্ধ হওয়ার চাইতে আত্মার চুক্তিবন্ধ হওয়া বেশী জরুরী। সেই জায়গাটা সুকৃতি অনুভব করেছে। বাবা হিসাবে তিনি গর্বিত যে তার মেয়ে এমন ব্যতিক্রমি একটা সিন্ধান্ত নিয়েছে। 

এ ঘটনায় প্রথমে বরযাত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেও পরে সকলেই প্রসংশায় ভাসিয়েছেন নব দম্পতিকে। জীবনের প্রথম এমন বিয়ে দেখে রীতিমতো হতবাক তারা। 

স্থানীয় বাসিন্দা গুলজান বেগম জানান, তিনি তার জীবনে এমন ব্যতিক্রমি বিয়ে দেখেননি। বিয়ে বাড়িতে এসে বর কনের গাছ লাগানো দেখে তার খুবই ভাল লেগেছে। নতুন দম্পতি সুখে শান্তিতে থাকুক এমন শুভকামনা জানান তিনি।

কনে সুকৃতি আদিত্যর চাচা সৈয়দ মাসুম রেজা বলেন, দেনমোহর নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবসময় কনেদের বা কনেপক্ষকে টাকার অংক বাড়ানোর প্রবণতা দেখেছি। কিন্তু আমার ভাতিজি সুকৃতির বিয়েতে ব্যতিক্রম দেখলাম। তার এই ব্যতিক্রমি চিন্তাধারার জন্য তাকে অন্তর থেকে আশির্বাদ ও সাধুবাদ জানাই।

নাটোরের দিঘাপতিয়ার বাসিন্দা লিটন-সুস্মিতা দম্পতির একমাত্র কন্যা সুকৃতি আদিত্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স এবং কুমিল্লার বাসিন্দা নাবিন আদনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। নাবিন এখন ঢাকায় একটি প্রাইভেট এড এজেন্সিতে শিল্প নির্দেশক হিসাবে কাজ করছেন। বছর ছয়েক আগে তারা পূর্ব পরিচয় থেকে ভালবাসার বন্ধনে জড়ান। পরে দু’পারিবারের সম্মতি নিয়ে সুকৃতি-নাবিন পরস্পর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।

প্রতিবেদক: নাজমুল হাসান, সিনিয়র করেসপনডেন্ট, যমুনা টেলিভিশন।